গল্প নয়

আলফানসো

করোনার সময় আলফানসো আম খাওয়ার অভিজ্ঞতা

আলফানসো নাকি আমের রাজা, বেশ একটা বিদেশী বিদেশী ভাব আর দামও সেরকম। একটা আলফানসো আমের বদলে প্রায় কেজি খানেক বা বেশী হিমসাগর পাওয়া যাবে, সুতরাং মাহাত্ম্য তো কিছু একটা আছেই। এই গুণমান আর দামের সাথে সমঝোতা করতে গিয়ে সত্যি কথা বলতে কি, আলফানসো আম আর খেয়ে হওয়া ওঠে নি। তাছাড়া আলফানসো সব জায়গায় পাওয়াও যায় না। প্রতিবারই বাড়ীতে বলি যে আলফানসো আনাব, কিন্তু সেই আনানো টা আর হয় নি। আমার গৃহিনী আমার এই সুপ্ত বাসনা টি জানতেন আর এই অতিমারী আর অসহায়তার বাজারে সেই অসাধ্য কান্ডটাই ঘটিয়ে দেখিয়েছেন, অন লাইন বুক করে আলফানসো আম আনিয়েছেন।

আমি সংসারের সাতে পাঁচে থাকি না, গৃহিনীই সব ব্যবস্থা করেন। আর সত্যি কথা বলতে কি ওনার নেটওয়ার্ক খুব ভাল, নিঃশব্দে সব কাজ হয়ে যায়। মা আর মেয়ের যুগলবন্দীতে মাখনের মত সব চলে। মাঝে মধ্যে আমাকে ওটিপি বলতে বলে আর আমি বিনা বাক্যবায়ে বলে দিই, জানতেও চাই না কিসের জন্য বা কি কেনা হল। এই স্বার্থত্যাগ নিজের স্বার্থেই কারণ শান্তিতে, কোন কাজ না করে আরামে থাকতে কে না চায় বলুন। প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছি, সেই আম খাওয়ার অভিজ্ঞতাই এবার বলি।

দিন তিন চার আগে একদিন বিকালের দিকে ডাইনিং টেবিলের ওপর দেখি বাটিতে রাখা পাঁচটা আম। গিন্নী মুচকি হেসে বললেন যে এই নাও তোমার আলফানসো, পাওয়া গেছে। কত দাম জিজ্ঞাসা করাতে বললেন যা চারশো টাকা, মানে একটা আমের দাম আশি টাকা। শুনে বললাম যে আমি কিন্তু আশি টাকা গোটা খাব, কেটে খাব না। তার উত্তর এল যে আজ আর নয় কাল সকালে খেও। আমিও আর কথা বাড়ালাম না কারণ আমার বহুদিনের বাসনা পূর্ণ হয়েছে।

রাত্রে ডিনার খেতে খেতে আমার টিভি দেখার অভ্যাস, সেদিনও তাই করছি। হঠাৎ দেখি প্লেটে করে গোটা আম কেটে গিন্নী দিয়ে গেলেন, মানে প্লেটে পুরো আশি টাকা কেটে কুটে সুন্দরভাবে সাজানো, খালি খাওয়ার অপেক্ষা। জিজ্ঞাসা করাতে বললেন যে তুমি বিকেলবেলা আলফানসো খেতে চাইলে তাই দিলাম। এ তো “মেঘ না চাইতেই জল”, তখনকার আনন্দ বলে প্রকাশ করতে পারব না। একটা সামান্য ফল ও যে এত আনন্দ দিতে পারে সেটি অনুভব না করলে জানতেই পারতাম না। খাওয়া শেষ করে আমের প্লেট হাতে নিলাম।

আমটার একটা সুন্দর গন্ধ আছে। সেই আবেশেই আমের চাকায় একটা আলতো কামড় দেওয়ার পরই চক্ষু চড়কগাছ, রাম টক যে। হালকা একটা মিষ্টি ভাব আছে কিন্তু পুরোটাই টকে ভরা। দু এক কামড় দেওয়ার পর দাঁতে কিন্তু শিরশিরানি শুরু হয়ে গেছে। আমি টক খেতে পারি, তাই বলে এই টক? আমের আঁটিটা যখন খাচ্ছি তখন আমার সাপের ছুঁচো গেলার অবস্থা, না পারছি খেতে না পারছি ফেলতে, চোখের সামনে আশি টাকা ভাসছে,ফেলে দেব? আমটিকে উদরস্থ করতে করতে টকে মাথা অবধি ঝিমঝিম করতে শুরু করে দিয়েছে। যাই হোক কোনও রকমে আলফানসো কে উদরস্থ করে উঠে পড়লাম। এত দিনের বাসনার এই যে করুণ পরিণতি হবে কে জানত।

দিন তিন চার হয়ে গেল, বাকি চারটি আম তখনও অটুট,অক্ষত। আমার করুণ অভিজ্ঞতা শুনে আমার বাড়ীর কেউই আর ওদিকে হাত বাড়ায় নি। তার ওপর আমার মত আম-প্রেমিক আর বাড়ীর কেউই নয়। আজই একটু আগে আমার এক অতি কাছের বন্ধুর কাছে আমার আলফানসো খাওয়ার অভিজ্ঞতা বলাতে সে বলল যে তার অভিজ্ঞতা আরও করুণ। বড়বাজার থেকে আলফানসোর পেটি কাঁধে করে নিয়ে এসে শেষমেষ আমের চাটনি করে খেতে হয়েছিল, অত দামী জিনিষ কি ফেলা যায়?

ডাইনিং টেবিলের ওপর আলফানসোগুলো সযত্নে আজকেও শোভা বর্দ্ধন করছে। পাশে দেখি এক ডাঁই হিমসাগর রাখা আছে, বেশ ভালো চেহারার, সত্তর টাকা কেজি। সন্তর্পণে আলফানসো গুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে চলে এলাম, যদি আমার মনোবেদনা বুঝে নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করে, রূঢ়তার বদলে যদি দয়াপরবশ হয়ে মিষ্টত্ব প্রদর্শন করে। কারণ আর কিছুই নয়, ওগুলো আমাকেই উদরস্থ করতে হবে ফেলা যাবে না। কি আর করব, ভিটামিন সি ভেবে কষ্ট করেও খেয়ে নেব। তবে এটা ঠিক যে আমার যথেষ্ট শিক্ষা হল, নেড়া বেলতলাতে একবারই যায়। আমার হিমসাগর, ল্যাংরা, চৌষা জিন্দাবাদ, সর্বোপরি অফিসিয়ালি বরাদ্দ তো একচাকা, অত লোলা কিসের? একেই বলে বোধহয় বোধোদয় বা ঠেকে শেখা।