ছেলেটি
সেদিন অফিস যাওয়ার পথে ছেলে্টিকে প্রথমবার দেখলাম, আগে কোনদিন দেখিনি। ছেলেটি বলার চেয়ে পাগলটাকে বলাটাই হয়ত ঠিক হত কিন্তু মনটা সায় দিল না। কতই বা বয়স, তিরিশ বত্রিশ হব, দেহাতী বলেই মনে হল। লম্বা দোহারা চেহারা, শ্যামলা রঙ, পরনে নোংরা ফুল প্যান্ট আর শতচ্ছিন্ন জামা। মাথায় বহুদিনের না কাটা উস্ক-খুস্ক চুল আর গালভর্তি দাড়ি, ঠিক রাস্তা ঘাটে দেখতে পাওয়া আর সব পাগলদের মত। পাগল হলেও ছেলেটির মধ্যে একটা আশ্চর্য্য শান্ত সমাহিত ভাব ছিল। চোখের উদভ্রান্ত ঘোলাটে দৃষ্টির মধ্যেও আলাদা এক ঔজ্জ্বল্য, পাগল কিন্তু পাগল বলতে বাধে।
অফিসে ঢোকবার রাস্তার খানিকটা দূরে ছেলেটা চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। দলে দলে লোক অফিসে ঢুকছে আর ছেলেটি অপলকনয়নে সেই দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টির মধ্যে কেমন যেন একটা উদাসীনতা, সব হারানোর বেদনা। অনেকেই দেখলাম ছেলেটিকে ঘুরে ঘুরে দেখছে। রাস্তাঘাটে তো কত পাগল দেখতে পাওয়া যায়, কজন তাদের খেয়াল করে। এই ছেলেটি পাগল অথচ কেমন যেন অন্যরকম। মনে হল ছেলেটা যেন কাউকে খুঁজছে, কিছু যেন একটা বলতে চায়। সময় থাকলে হয়ত ছেলেটির সাথে কথা বলতাম, ওর সম্মন্ধে জানার চেষ্টা করতাম, কিন্তু সে সময় ছিল না, অফিসের গেটে ঢুকে যেতে হল।
অফিসে কাজের মধ্যে বারবার ছেলেটার কথা মাথায় ঘুরছিল, ভেবেছিলাম অফিস ফেরতা পথে ওর সব খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করব, যদি কিছু করা যায়। অফিস থেকে বেড়িয়ে ওকে অনেক খুঁজলাম, কোথাও পেলাম না, মনটা বেশ ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। মনে হল যে এই ছেলেটিও তো কারও সন্তান, কারুর ভাই বা দাদা। হয়ত বিয়েও হয়েছে এবং ঘরে স্ত্রী সন্তান রয়েছে। কোন সূদুর পরবাসের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এখানে এসেছে রুজির খোঁজে, তারপর মাথার গন্ডগোল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ দেখার নেই, কেউ শোনার নেই। হয়তবা সূদূর সেই গ্রামে তার দুখী মা ছেলের ফেরার পথ চেয়ে বসে আছে। অথবা তার স্ত্রী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে বসে আছে কবে তার স্বামী কিছুদিনের জন্য ঘরে ফিরবে। প্রবল উৎকণ্ঠায় তার দিন কাটছে দীর্ঘদিন স্বামীর খোঁজখবর না পাওয়ায়। অসহায় অবস্থায় একান্তে নিভৃতে চোখের জল ফেলছে আর প্রত্যেকদিন নতুন আশায় বুক বাঁধছে স্বামীর খবরের আশায়।
আর কোনোদিন ছেলেটিকে আমি দেখিনি। জানিনা এই গল্পের শেষ কোথায়? ছেলেটি কোনদিন দেশে তার নিজের বাড়ীতে ফিরে যেতে পারবে কি না, না এইরকমভাবে পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে পাগল পরিচয় নিয়েই তার জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। এইরকম হাজারো ঘটনা আমাদের চারপাশে অবিরত ঘটে চলেছে আর আমরা তার নীরব সাক্ষী। এই অসহায় মানুষদের পাশে যাঁরা দাঁড়ান, তাঁরাই আসল মানুষ, ঈশ্বর তাঁদের মধ্য দিয়েই প্রতিভাত হন। আমরা তো ইশ্বরেরই সৃষ্ট মানুষ নামক সে জীব যারা পৃথিবীর বোঝা হয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দেয়, কোনো কাজে আসে না।