গল্প নয়

গামলাদা

ছোটবেলায় পাড়ায় পাড়ায় কিছু মজাদার চরিত্র থাকতো যাদের পিছনে লেগে ছেলেপিলেদের অনেকটা সময় কেটে যেত।

প্রত্যেক মানুষেরই অভিজ্ঞতার ঝুলি কমবেশী ঘটনায় সমৃদ্ধ এবং তার মধ্যে নানান রকম বর্ণময় চরিত্র লুকিয়ে থাকে। এইরকম ই একটা চরিত্র গামলাদা, যাকে নিয়ে আমাদের ছোটবেলার অনেকটা সময় কেটেছে। গামলাদার কথাই এখন আমি বলব।

আমাদের বাসার খুব কাছে থাকত গামলাদার পরিবার। গামলাদার দাদা আমার বাবার সহকর্ম্মী ছিলেন, আর সেই সুত্রে আমাদেরও চিনতেন, যদিও যাওয়া আসা ছিল না। গামলাদা সবাইকে সেরকমভাবে না চিনলেও পাড়ার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা গামলাদাকে খুব ভাল করে চিনত কারণ গামলাদা যেখানেই যেত সেখানেই এদিক ওদিক থেকে বিভিন্ন স্বরে “ এই গামলা ‘ বা ‘এই ব্যাটা গামলা “ বা শুধু “ গামলা “ আওয়াজ ভেসে আসত আর গামলাদার বাণী শুরু হয়ে যেত। সত্যি কথা বলতে কি, সেই সময়ে আমাদের অনেকেরই নতুন নতুন শব্দের সাথে পরিচিতি গামলাদার বাণীর মাধ্যমেই হয়েছে।

গামলাদার পোষাকী নাম কি কেউ জানত না আর আমার ব্যক্তিগত ধারণা যে গামলাদা নিজেই নিজের পোষাকী নাম ভুলে গিয়েছিল। এহেন গামলাদার গায়ের রঙ ছিল ফর্সা, মুখের একদিক ছোটবেলায় পুড়ে যাবার ফলে তামাটে বর্ণের পোড়া দাগ আর চুল একেবারে উত্তমকুমারের ষ্টাইলে আঁচরানো। গামলাদার ছিল মাঝারি দোহারা চেহারা আর বলাই বাহুল্য মাথায় ভালই ক্রীং ছিল।
গামলাদা রাস্তায় বেরুলেই চারিদিকে যেন খবর চাউর হয়ে যেত আর এখান ওখান সেখান থেকে বিভিন্নভাবে “গামলা” বলা শুরু হয়ে যেত। এরকম ও হয়েছে যে কোনো বাড়ির ভিতর থেকে গামলা আওয়াজ এসেছে আর গামলার সেই বাড়ীর উদ্দেশ্যে চিল চীৎকার। গামলা বলার কল্যাণে আর বাবার বন্ধুর অভিযোগের ভিত্তিতে বাবার কাছে যে বকাঝকা একদম খাইনি তাও কিন্তু নয় তবে এটা দিব্যি দিয়ে বলতে পারি যে বাবাকেও “ এই গামলা “ আওয়াজ শুনে মুচকি হাসতেও দেখেছি। গামলা ছিল এমনই নির্ভেজাল হাসির খোরাক।

আমাদের পাড়ায় ছোটখাট অনুষ্ঠান প্রায়ই লেগে থাকত আর দুর্গাপূজার মিটিং এ বেশ ভাল জমায়েত হত। এহেন দুর্গাপূজার মিটিং এ পাড়ার ছেলেবুড়ো সবাই হাজির আর কপালগুণে গামলাদাও। বাবলুদা, যে সবসময় রামনাম জপ কোরার মত গামলানাম জপ করত, সে সবার মাঝখানে গামলাদার সামনেই আমাদের শাসন করার ভঙ্গীতে বারবার বলে চলেছে যে “ এই ছোটরা, তোমরা কেউ যদি গামলাদাকে একবারও গামলাদা বলেছ তো তোমাদের মিটিং থেকে বার করে দেওয়া হবে”। আর গামলাদাও বাবলুদার শাসন শুনে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ছে, ভাবখানা এমন যে সে কত Important লোক। সবাই ম্যায় সভায় উপস্থিত কাকা – জ্যাঠারাও বাবলুদার এই কান্ড কারখানা দেখে আর আসল উদ্দেশ্য ট্যাঁ বুঝতে পেরে মুচকি মুচকি হাসছেন আর আমাদের কথা তো ছেড়েই দিলাম। গামলাদা কিন্তু নির্ব্বিকার আর বিজ্ঞের মত ভাব নিয়ে বসে আছে।

Meeting শুরু হল। একে একে President, Secretary, Treasurer থেকে Members অবধি ঠিক হয়ে গেল। আমাদের মতন ছোট ছেলেদের নাম ও Member List এ ঢুকে গেল।, Meeting শেষ হব হব, এইসময় বাবলুদা হঠাত দাঁড়িয়ে বলল যে আমার একটা প্রস্তাব আছে। সভাপতি ঘোষ জ্যেঠু, যাঁকে সবাই বেশ সম্মান করত, বললেন “ কি প্রস্তাব বাবলু তোমার?। বাবলুদা বলল এবার একটা নতুন পদ তৈরী হোক আর গামলাদাকে Assistant Member করে দেওয়া হোক। এই প্রস্তাব শুনে দেখি ঘোষ জ্যেঠুও ঘাড় ঘুরিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন আর Meeting এ সশব্দে হাসির রোল উঠল আর সমস্বরে এই প্রস্তাবে সবাই সমর্থন করল। গামলাদা কি বুঝল কে জানে, উঠে ডাঁড়িয়ে হাতজোড় করে সম্মতিসূচক ভঙ্গীতে “ আমি আবার কেন, আমি আবার কেন “ বলাতে আর এক দফা হাসির রোল। Meeting শেষ হবার পর গামলাদা যখন ফিরে যাচ্ছে তখন কোরাসে “ গামলা, গামলা” আওয়াজ শুনেও গামলাদা পদ পাবার আনন্দে কোনও কিচ্ছু না বলেই চলে গেল।

পাড়া ছেড়ে দিয়ে বহুবছর কেটে গেছে, পুরানো লোকেদের সাথে যোগাযোগ নেই বললেই চলে।গামলাদা যদি আজ বেঁচে থাকে তবে বছর পঁচাত্তর বয়স তো হবেই বা আরও বেশী। কেমন আছে, কোথায় আছে বা আদৌ বেঁচে আছে কিনা কে জানে? যদি কোনদিন আচমকা রাস্তায় গামলাদার সাথে দেখা হয়ে যায় তবে যে পরিস্থিতিতেই থাকি না কেন, আমার মুখ ফস্কে “গামলাদা” যে বেরুবেই সে ব্যাপারে আমি একশোভাগ নিশ্চিত। তবে সেক্ষেত্রে গামলাদার বয়সটা মাথায় রেখে “ গামলাদা”র বদলে “গামলাদাদু” বলাই সমীচিন হবে।