গোপাল ঘুগনী
বহুদিন আগে ফেলে আসা ছোটবেলার কিছু সামান্য ঘটনা যা আজ ও মনকে নাড়া দেয়।
আমাদের ছোটবেলায় মানে আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ- পঞ্চান্ন বছর আগে, স্কুলজীবনটা অনেক সোজা সরল আর আনন্দের ছিল, শৃঙ্খলতার মধ্যেও একটা আন্তরিকতা , একটা ভাল লাগা ছিল। এককথায় চাপমুক্ত জীবন ছিল আর সেই জন্যই হয়ত বা অনেক ছোটখাট মজার ঘটনা ঘটত।
তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। আমাদের সাথে গোপাল বলে একটা ছেলে পড়ত। গোপালের গায়ের রং ছিল বেশ ফর্সা তবে শরীরের গঠনটা ছিল একটু অদ্ভুত। ওই বয়সের ছেলেদের চেয়ে লম্বা বলতে বেশ খানিকটাই বেশী, গলা তার চেয়েও লম্বা। মুখটা ত্রিকোনা, কানদুটো বেশ বড়ো বড় আর গোলগোল দুটো চোখ। সব মিলিয়ে একটা কিম্ভুত কিমাকার চেহারা। ওর হাঁটা চলা , কথাবার্তা, তাকানো সবই ছিল অদ্ভুত, একেবারে ET সিনেমার ET.
গোপালকে আমরা খুবই কম পেয়েছি কারণ ও স্কুলে ভীষণ অনিয়মিত আসত, ওকে প্রায় দেখাই যেত না। একদিন দেখি যে একজন অতি সাধারন মহিলা আমাদের ক্লাসঘরের সামনে এসে গোপালের খোঁজ করছেন, দরকারে। আমাদের ইংলিশ ক্লাস চলছিল আর ক্লাস নিচ্ছিলেন বিজন স্যার, একজন খুবই ভাল আর দরদী মানুষ। স্যার বাইরে এসে ওনার সাথে কথা বলে আমাদের কয়েকজনকে ডাকলেন, কেউ যদি ওনাকে গোপালের খবরাখবর দিতে পারি। বলাই বাহুল্য যে সেদিনও গোপাল আসেনি।
ওনার সাথে কথা বলে জানা গেল যে গোপাল রোজ স্কুলের সময় স্নান করে, ভাত খেয়ে বইপত্তর নিয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে। মার কাছ থেকে টিফিনের পয়সাটাও নিয়ে নেয়, তারপর স্কুলের সময় শেষ হলে বাড়ী ফেরে, কোনদিন তার কামাই নেই। অথচ বাস্তবে গোপাল একদিন সপ্তাহে স্কুলে আসে বা তাও নয়। তাহলে সে যায় কোথায় বা সময়টাই বা কাটায় কিভাবে? গোপালের মা আমাদের কথা বিশ্বাসই করতে চাইছিলেন না যে গোপাল স্কুলে আসে না। স্যার বলাতে হয়রাণ হয়ে মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে বাড়ী ফিরে গেলেন।
পরের দিন গোপালের মা গোপালকে নিয়ে ক্লাসে হাজির। গোপালের মুখ চোখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে স্কুল কামাই করার জন্য ওর ওপর চড় থাপ্পরের অবিশ্রান্ত বর্ষণ হয়েছে এবং আমাদের এবং স্যারের সামনেই ওর মা আরও দু এক ঘা লাগালেন। ওর মার উপস্থিতিতেই গোপাল স্যারকে জানাল যে বাড়ী থেকে বেড়িয়ে ও অন্য পাড়ায় একটি মাঠের ধারে ঘুগনীওয়ালার কাছে যায়, তার কাছে বই খাতা রেখে টো টো করে ঘুরে বেড়ায়, ফেরার সময় ঘুগনী খেয়ে ফেরে। এটাই তার নিত্য নৈমিত্তিক রুটীন। ওর পড়াশুনা করতে ভাল লাগে না, তাই এইভাবেই সময় কাটায়, বুঝতে পারেনি যে মা স্কুলে পৌঁছে যাবে।
যাই হোক, এরপর কিছুদিন মানে মাসখানেক গোপাল নিয়মিত স্কুলে আসত। এই একমাসে আমরা ওই ঘুগনীর এত সুখ্যাতি গোপালের কাছে শুনেছি যে খুব অল্পদিনেই ও গোপাল ঘুগনী বলে পরিচিতি পেয়ে গেল আর আমরাও ওর পদবীটা ভুলে গেলাম। এমনকি মাষ্টারমশাইরাও ওকে মাঝেমধ্যেই গোপাল ঘুগনী বলে ডাকতেন। কিছুদিন নিয়মিত স্কুলে আসার পর গোপাল ধীরে ধীরে স্বমহিমায় ফিরতে লাগল। তারপর একসময় পুরোপুরি স্কুলে আসা বন্ধ করল। এরপর ওকে আর কোনদিন দেখিনি বা খবর ও পাইনি। গোপাল ঘুগনী ক্লাস ফাইভেই ওর পড়াশুনার অধ্যায়ের ইতি টেনে দিল।
আজ এতবছর বাদেও গোপাল ঘুগনীর কথা যখন মনে পড়ে তখন নিজের মনেই হাসি। বর্তমানের দিকে তাকাই আর ভাবি যে আমাদের স্কুলজীবন কত আনন্দদায়ক ছিল, গোপাল ঘুগনীর মত কত নির্ভেজাল সরল সাধাসিধা চরিত্র ছিল যা এখন হাজার খুঁজেও পাওয়া যাবে না। গোপালের চেহারাটা এখনও চোখের সামনে ভাসে আর ওর কথায় কথায় বলা “ একবার যদি ওই ঘুগনী খাস না, সব কিছু ভুলে যাবি”। দুর্ভাগ্য যে গোপালের ওই ঘুগনী চাখা হয় নি।