কয়লা
দৈনন্দিন জীবনের কিছু কিছু অভিজ্ঞতা গল্প মনে হলেও বাস্তবের চেয়ে অনেক বেশী সত্যি।
দৈনন্দিন জীবনের অতি ছোটখাট সাধারন ঘটনা, অতি সাধারণ মনে হলেও মাঝে মাঝে যে কি বিপাকে পড়তে হয় তার আমি প্রত্যক্ষ্য ভুক্তভোগী তবে আমার মনে হয় যে এরকম ছোটবড় অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই আছে যা আমরা চুপচাপ হজম করে যাই।
ছেলে তখন কোন ক্লাস এ পরে ঠিক মনে নেই তবে ক্লাস ফাইভ বলেই মনে হচ্ছে আর বাংলা মাধ্যম। আমি বরাবরই ছেলের পড়াশুনা থেকে শত হস্তে দূরে থাকতাম আর এই নিয়ে আমার অর্ধাঙ্গিনীর বিস্তর অভিযোগ ছিল আমার বিরুদ্ধে। আমি কায়মনোবাক্যে সেটা মেনে নিয়ে পড়ানো নামক যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে মহানন্দে থাকতাম। ছেলেকে পড়ানোর চাপের চেয়ে স্ত্রীর গঞ্জনা সহ্য করেও মুক্তির এই আনন্দ আমার কাছে অনেক বেশী ছিল। বলাই বাহুল্য যে আমার স্ত্রী অগত্যা ঘরের সব কাজের সাথে সাথে ছেলের পড়াশুনার দিকটাও সামলাতে বাধ্য হতেন।
এহেন আমার ওপর একদিন কি কুক্ষণে ছেলেকে পড়ানোর ভার পড়েছিল। যেহেতু আমি পড়াতাম না আর আমার সাথে ছেলের আবদারের সম্পর্ক ছিল, ছেলে নাচতে নাচতে বই নিয়ে আমার কাছে চলে এল। তারপর বই খুলে বলল, বাবা এটা পড়াও। দেখি কয়লা সম্মন্ধে লেখা। আমি সবেমাত্র কয়লা শব্দটা উচ্চারণ করেছি, ছেলার প্রশ্ন “ বাবা কয়লা কি?” আমি অবাক হয়ে বললাম ‘ আরে কয়লা কি জিনিস জানিস না? যা দিয়ে উনুন ধরায়।“ এবার প্রশ্ন “ বাবা উনুন কি?” “ আরে উনুন কি তাও জানিস না? কয়লা, ঘুঁটে দিয়ে উনুন ধরায় যে।“ বাবা ‘ঘুঁটে কি?” আমি তো পড়েছি মহা ফ্যাসাদে, বললাম “ আরে বাবা গরুর গোবর দিয়ে যে ঘুঁটে তৈরী হয়”। এবার এল মোক্ষম প্রশ্ন “ বাবা, গোবরটা কি সেটা তো বল? তুমি একের পর এক কি সব বলে যাচ্ছ, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না”।
আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে আমার তো ততক্ষণে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। ছেলের প্রশ্নবাণে আমি হোঁচটের পর হোঁচট খাচ্ছি কিন্তু এদিকে আমি তো মনঃশ্চক্ষে গোবর থেকে ঘুঁটে বানিয়ে, কয়লা ভেঙ্গে উনুন ধরিয়ে দিয়েছি আর সাদা ধোঁয়ায় রীতিমতন চোখ জ্বলছে। ছেলে অবাক বিস্ময়ে তার হীরো বাবার দিকে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে বাবা কেন তার কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না। আর আমার, মানে ছেলের বাবার, ফ্যালফ্যাল করে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। আমার স্ত্রী বোধহয় ব্যাপারটা লক্ষ্য করেই এসে বললেন “ অনেক পড়িয়েছ, এই তো মুরোদ, সামান্য কয়লা পড়াতে হিমশিম। ওঠ, আমি দেখছি”। আমি বাজী রেখে বলতে পারি যে সেদিন যে গতিতে আমি উঠে পড়েছিলাম, মাপতে পারলে বিদ্যুৎ এর গতিও হার মানত।
বিকালবেলা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করাতে বলল যে মা সব পড়িয়ে দিয়েছে কিন্তু গোবর, ঘুঁটে, উনুন সম্মন্ধে কিছু বলেনি। আমার পিতৃসত্তা জেগে উঠল, বুঝলাম জ্ঞান অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে। কিচ্ছু না বলে গাড়ী বার করে ছেলেকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। স্ত্রী, ছেলেকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞাসা করাতে বললাম যে ছেলেকে নিয়ে এই সামনেই ঘুরতে যাচ্ছি, ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে আসব। বেশী ভেঙ্গে আর বললাম না,কারণটা সহজেই অনুমেয়।
লবণ-হ্রদে থাকার সূত্রে মনে একটু দ্বিধাই ছিল যে ছেলেকে কত কি দেখাতে পারব, তবুও বেড়িয়ে পড়লাম। প্রথমেই এলাম পাড়ার মোরে,ওখানে উনুনে ভুট্টা সেঁকছিল। উনুন তো দেখালাম কিন্তু কয়লা পুড়ে পুরো ছাই হয়ে যাওয়ায় অনেক চেষ্টা করেও কয়লা দেখাতে পারলাম না। সারা লবণ-হ্রদ ঘুরে কয়লা তো দূর অস্ত গোবর ঘুঁটের চিহ্ন মাত্র খুঁজে পেলাম না। এদিকে ছেলের শিক্ষা অপূর্ণ থেকে যাবে এই মনের খচখচানি আর ওদিকে ছেলের বায়না যে তাকে এসব চাক্ষুষ দেখাতেই হবে, সব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমাদের পুরানো পাড়ায় যেতে হবে।
লবণ-হ্রদ থেকে আমাদের পুরানো পাড়াতে আসতে প্রায় মিনিট তিরিশেক লাগল। ওখানেও অনেক খুঁজে প্রায় টিমটিম করে বেঁচে থাকা একটা কয়লার দোকানে ছেলেকে কয়লা দেখালাম। এরপর গেলাম একটা খাটালে। সেখানে গোবর দেখাতেই ছেলের প্রতিক্রিয়া ‘”এ বাবা গরুর পটী” ! বাইরে বেড়িয়ে গোবর দিয়ে ঘুঁটে দেওয়া আর শুকনো ঘুঁটে দেখে ছেলে যথারীতি নাক সিঁটকালো। যাই হোক ছেলের শিক্ষা সম্পুর্ণ করে বাড়ীর পথে রওয়ানা দিলাম।
এইসব করতে করতে প্রায় ঘন্টা তিনেক কেটে গেছে, সন্ধ্যা গড়িয়ে খানিকটা দেরীই হয়ে গেছে। তখন মোবাইল ফোনের অত প্রচলন ছিল না, তাই দেরী হবার কোন খবর দিতে পারিনি, আর সঙ্গে ছো্ট ছেলে, বুঝতেই পারছিলাম যে বাড়ীর লোক বেশ চিন্তা করছে। যাই হোক বাড়ীর সামনে গাড়ী থামাতেই দেখি স্ত্রী থমথমে মুখে এসে কোনও কথা না বলে ছেলেকে নিয়ে ভিতরে চলে গেলেন আর গাড়ী গ্যারেজে ঢোকাতে ঢোকাতে শুনতে পেলাম যে ছেলে অতি উৎসাহে কোথায় কোথায় গিয়েছিল আর কি কি দেখেছে তার বর্ণনা তার মাকে সবিস্তারে দিতে শুরু করেছে। মনে মনে আমি প্রমাদ গুনতে শুরু করলাম। ঘরে ঢুকতেই দেখি বাবা মা বসে। বললেন বাবুকে নিয়ে গেছিস, দেরী হবে, সেটা বলে যেতে হয় তো, বৌমা ভীষন চিন্তা করছিল।
আমি আর কোনও রিস্ক নিলাম না। কোনরকমে নিজের ঘরে গিয়ে চট করে জামাকাপড় ছেড়ে বাইরের ঘরে বসে টিভি দেখতে শুরু করলাম। রাত্রে সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়াও সারলাম। এর মধ্যে আমার স্ত্রীর সাথে কোনই বাক্যালাপ হয়নি তবে ব্যাপারটা যে আর অত গম্ভীর নেই সেটা ওর মুখ দেখে বুঝে মনে মনে বেশ স্বস্তি পেলাম। খাওয়া দাওয়ার খানিকক্ষ্ণ বাদ শোবার ঘরে ঢুকলাম। ছেলে তখনো জেগে ছিল। স্ত্রীকে নিজে থেকেই, খানিকটা আত্মসমর্পণের সুরে দেরী হবার কারণটা বলতেই “একদিন পড়াতে বসিয়ে আদিখ্যেতার আর শেষ নেই, ছেলেকে যেন আইনস্টাইন বানাবে, নিজে তো বিরাট দিগগজ” বলে ঝাঁঝিয়ে উঠল। স্ত্রীর সেই রুপ দেখে কোনও কথা না বাড়িয়ে চুপ করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়েই শুনলাম ছেলে মাকে জিজ্ঞাসা করছে “মা আদিখ্যেতা মানে কি? বাবা দিগগজ কেন?”মনে মনে বলালাম শাবাশ বেটা চালিয়ে যা। এবার তোর মার জবাবা দেবার পালা।