গল্প নয়

সাদা কাক ( পর্ব্ব ৪ )

হেঁটে বাড়ী ফেরার পথে কাকটার কথা মাথায় ঘুরছিলো যে, ব্যাটা আমার ব্যাপারে সব খবরাখবর রাখে আর ওর informer ওকে খবর দেয়। এটা ঢপ বলে উড়িয়ে দেওয়াই যেত কিন্তু যেভাবে ব্যাটা আমার ঘরের সামনের জানলায় বসে ছিলো, ব্যাপারটা হাল্কা করে নেওয়ার কোনও জায়গাই নেই। কি করে কাকটার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় আর কেই বা ওর informer? আমি আমার হাঁটার পথ পাল্টে ফেলতেই পারি কিন্তু যেভাবে ও বাড়ী এসে হামলা করেছিলো পথ পাল্টে ফেলাটা কোনও সমাধান নয়। ব্যাটা আমাকে খুঁজে বার করবেই আর হয়তো আমাকে আরও বিরক্ত করে মারবে। অনেক ভেবে মনে হল যে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করাটাই একমাত্র সমাধান আর সেই ভাবেই আমাকে এগুতে হবে।

আমাদের মধ্যে একটা কথা চলে যে খুচরো পাপ। সত্যি, কিছু খুচরো পাপ নিশ্চয়ই করেছি নাহলে এরকম একটা উটকো ঝামেলা আমার ঘাড়ে এসে পড়বে কেনো? তবে কেনই বা কাকটা আমার পিছু নিলো আর কেই বা ওর informer সেটা আমাকে জানতেই হবে। আর এইজন্যই বাড়ী ফেরার পথে আমি একটা পাঁউরুটি নিয়ে ঘরে ঢুকলাম।

” কি ব্যাপার, তুমি পাঁউরুটি নিয়ে ঢুকলে, ঘরে তো পাঁউরুটি আছে, আমি কালকেই আনিয়েছি। একবার ফোন তো করতে পারতে। এখন এতো পাঁউরুটি কে খাবে?” গিন্নীর প্রশ্নবানে আমতা আমতা করে বললাম যে ” আমার মনে হল যে পাঁউরুটি নেই তাই”
” বাব্বা, তোমার মনে হল? সংসারের যে কত খবর রাখো। সংসারের কোনও কাজ ই তো করলে না, সারাজীবন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ালে, পাঁউরুটি নিয়ে এসে আদিখ্যেতা হচ্ছে”। আমি বেশ বুঝতে পারছি যে আমি কোনও বাজে দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, না হলে ঘরে বাইরে আমাকে এত ঝাড় কেন খেতে হচ্ছে। যাই হোক বাক্যব্যয় না করে সোজা নিজের ঘরে চলে গেলাম আর ভাবতে লাগলাম আগামীদিন কি করবো।

আমি অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে যাই আর আমার ঘর আলাদা। মেয়ে অনেক রাত অবধি নিজের পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে আর স্ত্রী ও জেগে থাকেন সুতরাং আমার বেরুনোর সময় ওরা ঘুমিয়ে থাকে আর আমি ঘরের চাবি নিয়ে বেড়িয়ে যাই। সেইজন্য সকালে উঠে দুটো পাঁউরুটিতে বেশ পুরু করে মাখন লাগিয়ে আর একটা ছোট জলেরর বোতলে জলের মধ্যে খানিকটা ভদকা মিশিয়ে বেড়িয়ে পড়তে কোনও অসুবিধাই হল না। গতকাল রাত্রেই প্ল্যান করেছিলাম যে ব্যাটাকে ভদকা খাইয়ে নেশা করিয়ে কথা বার করতে হবে। মনে একটা খটকা ছিলই যে আদৌ আমার এত প্ল্যান, পরিশ্রম কোনও কাজে লাগবে কি না।

পাঁউরুটিটা রাংতায় মুড়িয়ে আর জলের বোতল পকেটে গলিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। যদিও বনবিতানে কোনও কিছু খাবার নিয়ে ঢোকা নিষেধ তবুও অনেকেই বিস্কুট, পাঁউরুটি কাঠবিড়ালী, মাছ, পাখীকে খাওয়ান, সুতরাং আমি সেরকম কোনও অন্যায় করছি বলে মনে হয় না। আমি যখন বনবিতানে ঢুকলাম তখন খুব কম লোক এসেছে আর আমি সটান আমার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলাম।

রোজই ব্যাটাকে খুঁজতে হয় কিন্তু আজ যেতেই দেখি সামনের একটা গাছের ডালে বসে ঝিমুচ্ছে। আমি ভেবেই রেখেছি যে আজ থেকে ওকে আর তুই তোকারি করবো না, তুমি করে বলবো আর strategy হবে offence is the best defence, সেইজন্য ও কিছু বলার আগে আমিই বলবো। যা ভাবা সেই কাজ, ও আমাকে দেখার আগেই বললাম ” কি বাবাজীবন, ঘুম ভাঙ্গেনি? এখনও ঝিমুচ্ছ”। আমার কথার কোনও জবাব না দিইয়ে পিটপিট করে আমার হাতের দিকে চেয়ে বললো ” এই শালা তোর হাতে রাংতায় মোড়ানো ওটা কি রে? ছুঁড়ে মারবি নাকি? আজকে শালা আমার mood off আছে, শরীরটা ভালো নেই, একদম বিরক্ত করবি না”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম ” কি হয়েছে”
” আর বলিস না, বাগানে দেখছিস তো আম, কাঁঠাল খুব হয়েছে আর পেকে পেকে মাটিতে পড়ছে। কালকে লোভের বশে বেশী খেয়ে ফেলেছি, ব্যাস পেটে গ্যাস, অম্বল আর পেট ব্যথা। বেশ কয়েকবার হেগে মরেছি। সকাল থেকে তবুও অনেকটা ভালো কিন্তু শরীরটা ঠিক জুতসই নেই। তা তোর হাতে রাঙ্গতায় মোড়ানো কি আছে বললি না তো?”
” আর জেনে কি করবে, তুমি সেদিন মাখন দিয়ে পাঁউরুটি খাবার কথা বলেছিলে, তাই বেশ ভালো করে মাখন মাখিয়ে তোমার জন্য দু পিস পাঁউরুটি এনেছিলাম। তা তোমার পেট ভালো নয়, কি আর করা যায়, অন্য পাখিদের খাইয়ে দিই”
” এই খবরদার, কোথাও যাবি না, আমি খাবো। এমন কিছু হয়নি যে মাখন মাখানো পাঁউরুটি খেতে পারবো না। চল ওদিকে, এখানে একটু পড়ে ভীড়ভাট্টা শুরু হবে। আমার পিছন পিছন আয়” বলে একটু ভিতরের দিকে চলে গেল।

একটু ভিতরের দিকে আরোও নিরালা হলেও যেতে কোনও অসুবিধা হল না কারণ জায়গাটা কপোত কপতীদের একান্তে কাটানোর জন্যই তৈরী হয়েছে বলে মনে হয় আর আমি এই পথে খুব কম হলেও হেঁটিছি কয়েকবার।
” এই জায়গায় আমার মত পাকা চুলের মাথার লোকের আসা ঠিক হল, লোকে দেখলে ভাববে কি?”
” চুপ কর তো শালা, এখানে ঘন্টাখানেকের মধ্যে কেউ আসবে না। এখানে কারা, কখন আর কি করতে আসে আমি সব জানি। আর তোর মত দু একটা লোক যারা এখান দিয়ে হাঁটে তারা তো আজ হারগিস আসবে না কারণ গতকাল থেকে এখানে একটা সাপ ঘোরাফেরা করছে আর তারা সেটা জানে ” ।
” আরে বাপ সাপ, তাহলে বসে লাভ নেই, চলো অন্য জায়গায়”
” বোস ক্যাবলা, কিচ্ছু হবে না। ওটা তোর মতই ঢ্যামনা, ঢ্যামনা সাপ, যেটাকে তোরা দাঁড়াস বলিস, কামড়ালে কিচ্ছু হয় না। তাছাড়া আমি থাকতে ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি যেখানে থাকি ও আসে না, জানে যে এলে এমন ঠোকর খাবে যে বাবার নাম খগেন হয়ে যাবে। দে পাঁউরুটি দে।”

” আমি পাঁউরুটি বার করতেই বললো, একটা কথা বল, তোর আমার ওপর আচমকা এত পীরিত জন্মালো কেন রে? নিশ্চয়ই কোনও কু মতলব আছে।”
” যা বাবা ইচ্ছা হল আর সেদিন বললে যে কেউ পাঁউরুটি তে মাখন দেয় না, তাই মনে করে নিয়ে এলাম। তা তোমার যখন এতই অবিশ্বাস তখন খেয়ো না। বাজারে খাওয়ার লোকের অভাব নেই। আর সব কথায় ধান্দা দেখলে কোনও কথাই চলে না। যাই তাহলে”।
” আরে বোস বোস রেগে যাচ্ছিস কেন। কষ্ট করে এনেছিস যখন দে তাহলে।” আমি গোটা পাঁউরুটির পিস বার করতেই বললো যে ” লে হালুয়া টুকরো করে আনিস নি, দে ভালো করে ছোট ছোট করে ছিঁড়ে দে, দেখিস যাতে মাখন না পড়ে যায়, লেগে থাকে।”
আমি একটুকরো ছিঁড়ে এগিয়ে দিতেই বললো যে ” ওটা আগে তুই খা”
” আমি খাবো মানে”
” হ্যাঁ, তুই খাবি। তোরা জাতে মানুষ, যখন তখন শয়তানি করতে পারিস, পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না। শালা বিষ মাখিয়ে হসতে হাসতে খাওয়াতে পারিস। খা আগে।”
আমি মনে মনে ভাবলাম যে ব্যাটাটা ঠিক ধরেছে, এই প্ল্যানটাও তো করেছিলাম। কি হত তাহলে? যাই হোক আমি অম্লানবদনে টুকড়োটা মুখে পুরে দিয়ে খেলাম আর তীক্ষন চোখে ব্যাটা আমাকে দেখলো যে সত্যিই খেলেম না কায়দা করে ফেলে দিলাম।

যাই হোক আমি খাবার পর ও বলল “দে এবার”। আমার সামনে পুরো দুপিস পাঁউরুটি রসিয়ে রসিয়ে খেলো। আমি মনে মনে ভাবছি যে বাড়ীতে দু-পিস পাঁউরুটি খেলে আমার পেট ভরে যায় আর এই ব্যাটা কাক দু-পিস অম্লানবদনে সাঁটিয়ে দিলো?
“জল এনেছিস”
” হ্যাঁ এই নাও” বলে বোতল টা বার করে দিলাম।
” ছিপিটা খুলবে কে, আমার বাবা? আর একটা পাত্রে ঢেলে দে, বোতল থেকে খেতে পারবো না”
সামনেই একটা ডাবের শুকনো খোলা পড়ে ছিলো, তাতে জল ঢেলে দিলাম। জল তো বলছি কিন্তু ওতে তো ভদকা মিশিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। কাক অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে বেড়ায়, ও জল আর ভদকা মেশানো জলের তফাৎ কি বুঝবে। বিন্দাস তাই জল বলে এগিয়ে দিলাম।
আমার চমকানোর তখনও অনেক বাকী ছিলো। জলে চুমুক দিয়েই বললো ” এই হারামজাদা, তোকে জল দিতে বলেছিলাম, তুই ভদকা মেশানো জল দিলি কেনো? ভেবেছিস আমি ধরতে পারবো না?”

এটি যে হতে পারে তা আমার চিন্তা ধারণার বাইরে ছিলো আর হতভম্ব হয়ে গিয়ে বললাম ” না মানে “
” না মানে আবার কি? ভেবেছিস যে আমি বুঝতে পারবো না আর টাল্লি হয়ে গেলে আমাকে নিয়ে যা খুশী তাই করবি? মেরে ফেলার প্ল্যান?”
” আরে না না। বোঝেন ই তো বাড়ীতে মাল টাল খেতে দেয় না, তাই জলের বোতলে ভদকা মিশিয়ে কাজের টেবিলের তলায় লুকিয়ে রাখি রাখি আর সময় সুযোগ দেখে টুকটাক মারি। এমনি জলের বোতল ও তো থাকে। কোনটা আনতে কোনটা তুলে এনেছি। জীবনে প্রচুর চাপ, বোঝেন ই তো। ( Self Defence এ তুমি থেকে আপনি হয়ে গেলাম )। দাঁড়ান আমি এক্ষুণি আপনাকে জল এনে দিচ্ছি।” কোনরকমে গুল মেরে পরিস্থিতিটা সামলালাম।

কাকবাবাজী আমার দিকে এক অবিশ্বাসের দৃষ্টি দিয়ে বললো ” ঠিক বুঝতে পারছি না যে সত্যি বলছিস না নির্ভেজাল ঢপ মারছিস। অবশ্য তোদের জীবনে গৃহিণীর যা চাপ হতেও পারে। থাক তোকে আর জল আনতে হবে না ওই ভদকাটাই দে। অনেক দিন খাই নি, একটু আয়েস করে খাই।” এই বলে ছোট ১০০ মিলি লিটার ভদকা মেশানো জলের বোতলটা চুকচুক করে আমার চোখের সামনে মারছে আর আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি আর ভাবছি, এ ও ছিলো কপালে। কিছু করার নেই আর চলে যাওয়ার উপায় ও নেই। কাকেশ্বর মহারাজের চোখ ধীরে ধীরে ঢুলুঢুলু হয়ে আসছে আর মাঝে মঝেই গলা দিয়ে বিচিত্র সব আওয়াজ বের করছে, জানি না গান করার চেষ্টা করছে কি না। বুঝতেই পারলাম যে আমাকে এখনও অনেকক্ষণ বসে থাকতে হবে। দেরী হলে বাড়ীতে চিন্তা করবে তাই বাড়ীতে জানিয়ে দিলাম যে আমার ফিরতে দেরী হবে এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেছে। বন্ধুটা কে যদি জানতো।

One thought on “সাদা কাক ( পর্ব্ব ৪ )

Comments are closed.