গল্প নয়

সাদা কাক (পর্ব্ব ৩ )

গতকাল সারাদিন মেজাজটা বেশ খিঁচড়ে ছিলো, আর হবেই বা না কেনো, কিছুতেই সাতসকালে বজ্জাত কাকটার গালাগাল ভুলতে পারছিলাম না, আর তার ওপর বেমতলব গৃহিনীর ঝাড়। সব ওই কাকটার জন্য। তখন থেকেই মাথায় ঘুরছে যে কি করে ব্যাটার দফা রফা করা যায়। প্রথমে ভাবলাম কাল সকালে বনবিতানে পকেটে ছোট গুলতি নিয়ে যাবো কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সেই প্ল্যান বাতিল করলাম কারণ টিপের ” ট ” নেই আর চোখের দৃষ্টি বেশ কমজোর। এরপর ভাবলাম যে পাঁউরুটীতে ইঁদুর মারার বিষ মাখিয়ে ব্যাটাকে খাওয়াবো। সেটাও হবে না কারণ ব্যাটা যা সেয়ানা ঠিক ধরে নেবে আমার কোনও মতলব আছে, খাবে না, বেঘোরে অন্য কোনও পাখির প্রাণ চলে যেতে পারে। সবশেষে এই ঠিক করলাম যে পকেটে কিছু ঢিল নিয়ে যাবো, ঢিল ছুঁড়ে যদি ব্যাটাকে মারতে পারি, যদিও এখানেও বিস্তর প্রশ্নচিহ্ন।

গতকাল রাত্রেই একটু পরের দিকে নেমে রাস্তা থেকে কয়েকটা ঢিল কুড়িয়ে আনলাম আর আমার টেবিলে যত্ন সহকারে এক কোণায় এমন ভাবে সাজিয়ে রাখলাম যে চট করে চোখে পড়ার কথা নয়।কথায় আছে না যে যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয়, ঠিক তাই। আমার গৃহিণী নিজের কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকেন আর সচরাচর আমার ঘরে তাঁর ঢোকার প্রয়োজন হয় না। হঠাৎই কিছু একটা কাজে আমার ঘরে ঢুকলেন আর পড়বি তো পড় তাঁর চোখ পড়লো ওই ঢিলগুলির ওপর। ” একী, এই নোংরা পাথরগুলো টেবিলের ওপর কি করে এলো, এ নিশ্চয়ই তোমার কাজ। কি করবে এগুলো দিয়ে, আর টেবিলের ওপরই বা রেখেছো কেন? যত সব অকম্ম করে বেড়াবে “। এই বলে ঢিলগুলো নিয়ে, আমাকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা ব্যালকনীর ডাস্টবিনে। আমিও ছাড়ার পাত্র নই, সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর চুপিচুপি ব্যালকনীতে গিয়ে ডাস্টবিন থেকে ঢিলগুলো তুলে ঘরের কোণায় রেখে দিলাম, শালা কাকটাকে মেরেই ছাড়বো।

আজ সকাল সকাল ঢিলগুলো পকেটে পুরে একটু তাড়াতাড়িই বেরুলাম। উদ্দেশ্য লোকচক্ষুর আড়ালে কাকটার কিছু একটা ব্যবস্থা করা। বনবিতানে ঢুকে দেখলাম যে অত সকালেও কিছু মানুষজন এসে গেছেন। অবশ্য তাতে খুব বেশী সমস্যা হবার কথা নয় কারণ আমি যে দিকটায় যাবো সে দিকটায় খুব কম লোক যান। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। আমার গন্তব্যস্থলে এসে এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করলাম আর পকেটে হাত। ঘন গাছপালার মাঝ দিয়ে একটা ভাঙ্গাচোরা পিচের রাস্তা দিয়্যে হাঁটছি, ব্যাটা কোথাও নেই। হঠাৎ মাথার ওপর প্যাচ করে কিছু একটা পড়ল আর দেখি হারামজাদা কাকটা খ্যাক খ্যাক হাসতে হাসতে উড়ে গিয়ে সামনের গাছের ডালে বসল।
” আহা কি তৃপ্তি, এতদিন বাদে মনোবাসনা পূর্ণ হল। ঢ্যাঁড়োস টার মাথায় solid ঝেড়েছি” বলেই আবার খ্যাক খ্যাক করে হাসি। বুঝতে অসুবিধা হল না যে কাকটা আমার মাথায় হেগে দিয়েছে। ভাগ্য ভালো সামনেই একটা জলের কল ছিলো, ঢিল ছুঁড়বো কি, আগে ছুটে গিয়ে সামনের জলের কলের তলায় মাথা রেখে কল খুলে দিলাম।

” ভাইসাব আপকা তবিয়ত ঠিক হ্যায়? কেয়া হুয়া?” দেখি এক মাঝবয়সী হিন্দিভাষী ভদ্রলোক উৎকণ্ঠা নিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। যে কেউ যদি দেখেন যে সকালে একজন হাঁটতে এসে মাথায় জল দিচ্ছেন তার চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক।
আমি আমার বিশুদ্ধ হিন্দীতে বললাম
” হ্যাঁ, আমি ঠিক হ্যায়”।
” কেয়া হুয়া থা?”
” আরে ভাই কাক নে হাগ কিয়া”
” কাক মতলব কাউয়া, উয়ো হাগ কিয়া, তাজ্জব কি বাত। কাউয়া কেইসে হাগ কর সখতা হ্যায়”
” কি মুশকিল, আরে ভাই হাগ কিয়া মানে হেগেছে মানে টাট্টি কিয়া”
” রাম, রাম, এইসা বলিয়ে না। ম্যায় সোচ রাহা থা কি কাউয়া কেইসে Hug করেগা। চালিয়ে আপ কা তবিয়ত ঠিক হ্যায়, ইয়ে আচ্ছি বাত হ্যায় ।” এই বলে ভদ্রলোক নমস্কার করে চলে গেলেন। আমিও প্রতি ন মস্কার করে মাথাটা রুমাল দিয়ে মুছে নিলাম।

মাথাটা মুছতে মুছতে তাকিয়ে দেখি যে আমার ঠিক সামনের গাছের ডালে কাকটা এসে উড়ে বসলো। আমায় দেখছে আর খ্যাক খ্যাক করে হাসছে। রাগের চোটে পকেট থেকে ঢিল ছুঁড়ে মারলাম বটে কিন্তু সে ঢিল তো ব্যাটার ধারপাশ দিয়ে গেলোই না বরঞ্চ আমার ডান কাঁধের বহুদিনের পুরানো ব্যথা টনটনিয়ে উঠলো, উঃ বলে কাঁধটা চেপে ধরলাম। আর এই দেখে বজ্জাতটার হাসি দ্বিগুণ হয়ে গেলো, বললো,
“ব্যাটা বৃদ্ধ ভাম, দুদিন বাদে চিতায় উঠবি, ঢিল ছুঁরে আমায় মারবে। বেশ হয়েছে। পকেটে তো আরও ঢিল আছে ছোঁড়না, শালা হাতটা খুলে এবার পড়ে যাবে”।
আমি কাঁধে হাত বোলাতে বোলাতে বললাম যে ” তুই আমার পিছনে পড়েছিস কেন, আমি কি তোর পাকা ধানে মই দিয়েছি। তুই তো আমার জিনা হারাম করে ছেড়ে দিচ্ছিস, শান্তিতে বাঁচতে দিবি না। সকালবেলা হাঁটতে বেড়িয়েছি আর দিলি মাথায় হেগে। এবার থেকে দেখছি অন্য জায়গায় যেতে হবে। এই তুই আমার বাড়ীর ঠিকানাটা কোথা থেকে পেলি বল তো? “

বাড়ীর ঠিকানা্র কথা জিজ্ঞাসা করায় কাকটা মুচকি মুচকি হাসতে শুরু করলো, বললো ” আমার ও informer আছে রে পাগলা, এখানে বসে বসেই সব খবর পেয়ে যাই। তোর বাড়ীতে কে কে আছে, কা্রা তোর বাড়িতে আসে, কোন কোন লোক কাজ করে ম্যায় বাড়ীতে কি খাওয়া দাওয়া হয় সব জানি। তুই নিজের সম্বন্ধে যা জানিস তার চেয়ে হয়তো বেশীই জানি।”
আমি তো ব্যটার কথা শুনে তাজ্জব। কিছু কথা জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছি হঠাৎ ” যাঃ শালা, এই ক্যাবলার সাথে কথা বলতে গিয়ে আমার সকালের Breakfast টা গেলো, সব খেয়ে নিলো রে” বলে নিমেষের মধ্যে উড়ে বেড়িয়ে গেলো। আমিও এইসব কথা ভাবতে ভাবতে আমার হাঁটার Quota complete করে বাড়ী ফিরে এলাম। ব্যাটার সাথে ভাব করতে হবে, জানতে হবে সব কিছু,।