সাদা কাক ( শেষ পর্ব্ব )
কাক বাবাজীবন মাখন দিয়ে দুটো পাঁউরুটি আর ১০০ মিলি সামান্য জল মেশানো ভদকা মেরে যখন উঠলেন তখন মোটামুটি ফুল টাল্লি, চোখদুটো ঢুলুঢুলু আর কথাবার্তা বেশ জড়িয়ে গেছে। ঘড়িতেও সাড়ে সাতটা মতন বাজে, এইসময় আমি ঘরে ফিরে যাই, একটুও হাঁটা হয় নি আর এই মাতাল কাকের হাত থেকে কখন পরিত্রাণ পাবো জানি না।
” কিররররেরে শালা কাআআকেএএ ফোন করররছিলি, বৌকে? পীরী্রীরীত উথলে উঠেএএচে?”। বুঝতেই পারছেন ব্যাটার নেশা বেশ ভালোই হয়েছিলো আর কথা বেশ ভালোরকম জড়িয়ে গেয়েছিলো। জীবনে অনেক মাতালের পাল্লায় পড়েছি কিন্তু কাক মাতালের পাল্লায়েও যে পড়তে হবে সেটা বাবার জীবনে ভাবিনি। পোড়াকপাল আর কি।
” হ্যাঁ বৌকে জানালাম যে একটু দেরী হবে, নইলে চিন্তা করবে”
” শালা মেনীমুখো স্ত্রৈণ, বৌয়ের ভয়ে প্যান্ট ভিজে যায়”
( সব কথাই জড়ানো কিন্তু আর সেরকম ভাবে লিখছি না)
” আপনি এরকম বলছেন কেন, এটা খুব অন্যায়। বাড়ীর লোক চিন্তা করবে তাই জানিয়েছি”
” চুপ শালা ঢ্যাঁড়স, আতা ক্যাবলা, দে মাল দে”
” আর তো নেই”
” মাল নেই, কেন নেই? ভাগ শালা এখান থেকে” বলে শূণ্যে পা ছুঁড়লো। নির্ঘাৎ উদ্দেশ্য ছিলাম আমি কিন্ত মাতালের কি আর তাল ঠিক থাকে।
” আচ্ছা ঠিক আছে” বলে উঠতেই
” কি রে শালা পালাবি কোথায়, আমায় মাতাল পেয়েছিস নাকি? আমার মেজাজ এসেছে, আমি এখন গান গাইবো। চুপ করে বস।”
আমার তো , একেবারে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচির মত অবস্থা। কি ভাবলাম আর কি হল, একেবারে উলটো বুঝলি রাম অবস্থা। থপ করে বসে পড়লাম।
” এই শোন তোকে একটা গান শোনাই। কি গাইবো বল তো, রবীন্দ্রসঙ্গীত? না থাক।”
আমার মুখ দিয়ে স্বগোতোক্তির মত বেড়িয়ে গেল ” বাঁচলাম”
” এই শালা বাঁচলাম বললি কেন, আমি কি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারবো না” বলেই, একেবারে কাকের হেঁড়ে গলায় “এদিন আজি কোন ঘরে গো” ধরেই চুপ মেরে গেলো আর তার পরে ভেউ ভেউ করে কান্না। আমি তো পুরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।
” কি হল আপনার কাঁদছেন কেন?”
” কাঁদবো না,কত বিয়ে করার ইচ্ছা ছিলো। ভেবেছিলাম ঘর থাকবে, বৌ হবে, ছেলেপুলে হবে। সব আশা দুরশা, কিছুই হল না রে। সারাজীবন ব্যাচেলর হয়ে থেকে গেলাম আর ডালে ডালে রাত কাটালাম, বাসায় থাকা আর হল না” বলেই আবার ভেউ ভেউ করে কান্না।
” আরে আরে কাঁদেন কেন? সময় তো আছে। বিয়ে করে নিতেই পারেন, সব হবে”
আমার কথা শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে রাম খিস্তী দিয়ে ” শুয়োর, আতা কেলানে, ঢ্যাঁড়োস………( বাকী গুলো) লিখতে পারলাম না) এই বয়সে বিয়ে করব? জানিস আমার বয়স কত? তোদের নব্বই এর সমান। সর্ব্বাঙ্গ শিথিল হয়ে গেছে। কাটা ঘায়ে নুনের ছেটা দিচ্ছিস? দেখ তোর কি হাল আমি করি।”
এইবার আমার ভেউ ভেউ করে কান্নার অবস্থা ” আমি আবার কি করলাম? আপনাকে দেখে তো বয়স বোঝা যায় না বেশ শক্তপোক্তই লাগে, তাই বলেছি। আমার একেই নাজেহাল অবস্থা, এর ওপর আপনি যদি আরও বেশী আমার পিছনে লাগেন তো প্রাণে মারা যাবো”
আমার করুণ মুখ দেখে হয়তো দয়া হল ” আচ্ছা ঠিক আছে। ভুল করে বলে আমার মনে দাগা দিয়েছিস, আর বলিস না।”
এ যাত্রাতেও রক্ষা পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
” এই সেদিন তুই কি যেন জানতে চাইছিলি”
” হ্যাঁ, মানে আপনি আমার সম্বন্ধে এত খবর পেলেন কি করে”
” আমার খবর পেতে অসুবিধা, বলেই খ্যাক খ্যাক করে বিশ্রী একটা হাসি। আরে তোদের আবাসনে আমার ইনফর্মার আছে রে পাগলা”
” আপনার ইনফর্মার বলতে কাকের দল, তাই তো? আর আমার আবাসনের লোকেদের খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে তারা এর ওর ঘরের খোঁজ নিয়ে বেড়াবে। যত সব ভুলভাল কথা।”
” আচে, আচে তোদের মধ্যেই আমার ইনফর্মার আচে, তুমি জানতি পারো না। তাদের কাজ ই হচ্ছে সারাদিন ঘুরে বেড়ানো, চারিদিকে নজর রাখা, এর ওর বাড়ীর খবর কাজের লোকেদের থেকে নেওয়া আর চাউর করে বেড়ানো। এরা খালি নিন্দা করতে পারে, কি চরিত্র মাইরী। আমরা কাকেরা নোংরার মধ্যে থাকি, নোংরা খেয়ে বেড়াই কিন্তু তোদের মত এত অপরিস্কার মন নয় আমাদের, আমাদের ও কিছু নীতিবোধ আছে। কিন্তু তোরা, মাঝে মাঝে ঘেন্না হয় তোদের দেখে ” বলতে বলতে কাকটা একটু সেন্টু হয়ে গেলো আর বেশ বুঝলাম যে ব্যাটা ঘুমে ঢুলে পড়ছে।
আরও অনেক কথা নেশার ঘোরে বললো কিন্তু আমার মাথায় কিছুই ঢুকছিলো না। আমি ভাবছিলাম যে সামান্য একটা কাক, সেও আমাদের চরিত্র নিয়ে কত বড় কথা বলে দিলো আর আমি তার প্রতিবাদ অবধি করতে পারলাম না কারণ সে এক বর্ণ মিথ্যা কথা বলেনি। কথাগুলো আমার মনকে ভীষণ নাড়া দিয়ে গেলো। চুপচাপ বসে থাকলাম যতক্ষণ না কাকটা ঘুমে ঢলে পড়লো আর তারপর ধীরে ধীরে বাড়ির রাস্তা ধরলাম। এ কদিন উঠতে বসতে কাকটাকে মনে মনে গালাগাল করেছি আর কিছুক্ষণ আগেও তাই। কিন্তু এখন বাড়ী ফিরছি হয়তো বা কাকটার প্রতি মনে খানেক সম্ভ্রম নিয়ে।
এর পরেও হয়তো কিছু বলার বা লেখার থাকতে পারতো কিন্তু হল না। আসলে সেদিন বাড়ী ফেরার পরের দিন আমরা সপরিবারে ছেলের কাছে ব্যাঙ্গালোরে চলে যাই দিন পনেরোর জন্য। এই সাদা কাক নিয়ে কারোর সাথেই কোনও আলোচনা করিনি, বাড়ীর লোকেদের সঙ্গেও না, আপনাদের ই প্রথম বললাম। ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরে আসার পর ও বেশ কিছুদিন হাঁটা হয়নি আর তাই বনবিতানে যাওয়াও হয়নি। প্রায় মাসখানেক পরে যখন যাই তখন পরপর কয়েকদিন গিয়েও কাকটাকে আর দেখতে পাই নি। হয়তো বা কোথাও উড়ে গেছে বা মরে গেছে, যা কিছু হওয়া সম্ভব । আজ ও যখন ওই নিরালা রাস্তা দিয়ে হাঁটি মনে হয় যে কেউ বলবে ” কিরে শালা, অনেক কদিন আসিস নি যে, ব্যাপারটা কি তোর?” আনমনে হেঁটে যাই বাকী পথ, মনটা কোথাও কি একটু হলেও বিষণ্ণ হয়, জানি না।
তৃতীয় চতুর্থ পার্ট পাইনি তবে পড়ে মন মজে গেছে সত্যিই-ই কাক-টা মরেনি হয়তো তোমার অনুপস্থিতির জন্যই ওর সারা দেওয়ার তাগিদ নেই তবে। দু-চার-পাঁচ অক্ষরের বচন দিলো বলে। খুব আনন্দই পেয়েছি লেখাটা পড়ে। অনেকদূর নিয়ে যেতে পারবে এই মজাদার গল্পটা। “হাল ছেড়োনা বন্ধু বরং কন্ঠ ছাড়ো জোরে; দেখা হবে তোমার-আমার নতুন দিনের ভোরে”।